ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

অর্ধেক খরচে কাটছে ধান, আউশে খুশি কৃষক

মো. জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২০
অর্ধেক খরচে কাটছে ধান, আউশে খুশি কৃষক

কুষ্টিয়া: শ্রাবণ মাস। আকাশে মাঝে মধ্যে মেঘ, হঠাৎ নামছে বৃষ্টি।

মাঠে কৃষকের পাকা আউশ ধান, রয়েছে সোনালী আশ পাটও। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির কারণে পাট জাগ দিতে সুবিধা হওয়ায় একদিকে পাট চাষিরা খুশি অন্যদিকে দুশ্চিন্তায় আউশ ধান চাষিরা। রয়েছে শ্রমিকের সংকটও।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের নওদা আজমপুর এলাকার কৃষক ফারুক হোসেন। তিনি দুই বিঘা জমিতে এবারে আউশ ধান চাষ করেছেন। শ্রমিক সংকটের কারণে কাটতে পারছেন না মাঠের পাকা ধান। এজন্য তিনি তার এক বিঘা জমির ধান নিজেই কাটছেন।

ফারুক হোসেন বাংলানিউজকে জানান, দুই বিঘা জমিতে আউশ ধান করেছি। এক বিঘা বাড়ির কাছে এবং যাতায়াতের রাস্তা ভালো থাকায় লেবাররা সেটা কেটেছে। আর এই জমির ধান বাতাসে পড়ে গেছে, জমিতেও কাদা তাই লেবাররা কাটেনি। নিজের ধান ফেলে তো দেওয়া যায় না। তাই নিজে নিজেই কাটছি। একদিনে তো পারবো না, দুই দিন লাগতে পারে। কাটার পর মাথায় টেনে রাস্তায় তুলতে হবে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ৪০০ টাকা দিন হাজিরা, তার সঙ্গে খাওয়া। তাও লেবাররা ধান কাটতে আসতে চাই না। একটু কাদা জমি আর দূরে হলে তো বিপদে পড়া লাগে। বৃষ্টির সময় যতো তাড়াতাড়ি ধান বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায় ততোই ভালো।

ফারুকের জমির পাশেই আড়াই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন শহিদুল ইসলাম। তার জমিতেও রয়েছে প্রচুর কাদা। তবে তার জমির ধানগুলো খুব একটা পড়ে যায়নি।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টির সময়, পাকা ধান নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলাম। পুরো মাঠের ধানই পাকা। এদিকে ধান কাটার লেবার পাওয়া যাচ্ছে না। এক বিঘা জমিতে লেবার দিয়ে ধান কাটতে চারটা লেবার লাগে। আর সেগুলো মাথায় করে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও দুইটা বেশি নিতে হবে। এরপরে ধান মাঠ থেকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে গাড়ি করে। সেখানে গাড়ির চালক ৩০ কেজি থেকে ৪০ কেজি ধান নিচ্ছে। এই ধান আবার মাড়ায়ের জন্য খরচ আছে। এক বিঘা জমির ধান মাড়াই করতে ২৫ কেজি ধান দিতে হবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার থেকে ৩২শ’ টাকা খরচ হবে।

তিনি আরও বলেন, এবার ধান কাটার আর চিন্তা করা লাগছে না। যেখানে লেবার দিয়ে ধান কাটতে একদিন লাগে সেখানে মাত্র আধা ঘণ্টায় এক বিঘা জমির ধান কেটে বস্তায় ভরে বাড়ি চলে যাচ্ছে। আর খরচও অর্ধেক। কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটার ফলে একদিকে যেমন পরিশ্রম কম, সময় কম লাগছে আবার খরচও অর্ধেক লাগছে।

মেশিন দিয়ে ধান কাটার প্রচলন গ্রাম অঞ্চলে আগে না থাকলেও বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাঠের পর মাঠ পাকা ধান মেশিনের সাহায্যে কেটে কৃষকের বাড়িতে দিয়ে আসছে। এটা যেনো এক উৎসবের সৃষ্টি হয়েছে।

একই এলাকার কৃষক রবিউল ইসলাম। দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি তার জমির ধান কেটেছেন। সেই সেঙ্গে মাঠ থেকেই কাচা ধান ৮০০ টাকা মণ হিসেবে বিক্রি করে বাড়ি ফিরছেন টাকা হাতে নিয়ে।

কৃষক রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, আড়াই বিঘা জমির ধান, এক ঘণ্টায় মেশিন দিয়ে কেটে শেষ। সেই ধান আবার পরিস্কার, মড়াই, বস্তাও ভরে দিচ্ছে। মাঠ থেকে ধান এনে রাস্তায় দিয়ে গেল। এখানেই ধানের ক্রেতা এসে কিনে নিয়ে গেল।

তিনি বলেন, যেখানে লেবার দিয়ে ধান কাটতে খরচ বেশি হতো, সময় বেশি লাগতো। সেখানে এতো দ্রুত ধান কেটে দিচ্ছে। মেঘ বৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই। আবার খড়গুলোও জমিতে জৈব সার করা যাবে।

কৃষক আব্দুল মালেক বাংলানিউজকে জানান, কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা সুবিধা। কম সময়ে, কম খরচে ধান কাটা যাচ্ছে। আবার ধান এক মাপে কেটে দিচ্ছে। জমি চাষের ক্ষেত্রেও সুবিধা। এছাড়া ধান মাড়াইয়ের কোনো ঝামেলা নেই। ধানে চিটাও কম থাকছে।

কম্বাইন্ড হারভেস্টার চালক সুজন আলী বাংলানিউজকে জানান, একটি হারভেস্টার দিয়ে এক ঘণ্টায় তিন বিঘা পর্যন্ত ধান কাটা সম্ভব। ধানের জমিতে কাদা থাকলেও ধান কাটা যায়। এক সঙ্গে ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই এবং বস্তায় ভরে দিচ্ছি। এক বিঘা জমির ধান কাটতে ২০-২৫ মিনিট সময় লাগছে। হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটতে আমরা বিঘাপ্রতি ১৩-১৪শ’ টাকা নিচ্ছি। খরচ বলতে বিঘা প্রতি চার লিটার ডিজেল তেল লাগছে। এতে কৃষকরা বেশ উপকৃত হচ্ছেন। সেই সঙ্গে বৃষ্টিতেও ধান নষ্ট হচ্ছে না। আর কৃষকরা বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ধান কাটার ক্ষেত্রে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের উপরে সরকার জোর দিয়েছেন। এতে সরকার কৃষকদের ভর্তুকি দিচ্ছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরেই মিরপুর উপজেলায় আটটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ৫০ ভাগ ভর্তুকিতে বিতরণ করা হয়েছে। বতর্মানে কৃষকদের ধান কাটতে উপজেলার বিভিন্ন মাঠে ১৭টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার কাজ করছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় মোট ২৭ হাজার ২২৮ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে জেলায় ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় জেলায় মোট ৩৩টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার এবং ১৩টি রিপার রয়েছে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় আমরা কৃষকদের ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি দিচ্ছি। ৫০ ভাগ ভর্তুকিতে আমরা কৃষকদের হারভেস্টার দিচ্ছি। কৃষকরাও হারভেস্টারসহ অন্য যন্ত্র ব্যবহারে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাইদ বাংলানিউজকে বলেন, কৃষিতে যান্ত্রিকশক্তির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচ কমানো এবং সময় বাঁচানো সম্ভব। ধান কর্তন, সংগ্রহ, ঝাড়াই ও মাড়াই এর ক্ষেত্রে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহার অধিক লাভজনক। এতে কৃষকদের সময় বাঁচে, অপচয় কম হয় এবং অর্থ সাশ্রয় হয়।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শ্যামল কুমার বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ধান ও গম কাটার ক্ষেত্রে শ্রমিক সংকট নিরসনের জন্য আমরা যান্ত্রিকশক্তি ব্যবহারে জোর দিয়েছি। সরকার হাওড় এলাকায় কৃষি যন্ত্রপাতির উপরে ৭০ ভাগ এবং অনান্য এলাকায় ৫০-৬০ ভাগ ভর্তুকি দিচ্ছেন। আউশ মৌসুমে কুষ্টিয়ার চাষিরা ধান কর্তনে লেবারের পরিবর্তে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহার করে বেশ লাভ করছে। বিশেষ করে মিরপুর উপজেলার কৃষকরা ধান ও গম কাটার জন্য শ্রমিকের পরিবর্তে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার বেশি ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।