ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

মাশরুম থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করেন সাগর

মো. জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩
মাশরুম থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করেন সাগর

কুষ্টিয়া: সাগর হোসেন। বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হোগলা গ্রামে।

দুই ভাইয়ের মধ্যে সাগর বড়। ২০১৫ সালে মাধ্যমিক এবং ২০১৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে রাজবাড়ি সরকারি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে (অনার্স) কোর্সে ভর্তি হন।  

বর্তমানে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। ছাত্রজীবনেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। নিজ বাড়িতে মাশরুম চাষ করে এখন তিনি বছরে আয় করছেন আট-১০ লাখ টাকা। তার দেখাদেখি এলাকার ও আশেপাশের বেশ কয়েকজন গড়ে তুলেছেন মাশরুমের বাণিজ্যিক খামার।

সাগরের উৎপাদিত মাশরুম উৎকৃষ্ট মানের। বাণিজ্যিকভাবে এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় তার মাশরুম। নিয়মিত তার খামারে এখন পাঁচজন শ্রমিক কাজ করেন। সাগরের পাশাপাশি তাদের পরিবারেও এসেছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।

২০২১ সালে যখন বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা মহামারি দেখা দেওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তখন বাড়িতে বেকার বসে না থেকে মাশরুম শুরু চাষ করেন সাগর।

উদ্যোক্তা সাগর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, করোনাকালে কলেজ বন্ধ হওয়ায় বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে অবসর সময় কাটাতাম। একদিন মোবাইল ফোনে মাশরুম চাষের একটি ভিডিও দেখি। সেখান থেকে ইচ্ছা হয়, আমি মাশরুম চাষ করলে ভালো হবে। চাকরি করা কিংবা এলাকার বাইরে থাকার ইচ্ছা আমার নেই। তাই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মাশরুম চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট পরিসরে ২০০টি ওয়েস্টার পিও-২ জাতের মাশরুমের স্পোন নিয়ে আমি বাড়িতেই কাজ শুরু করি। এরপর মাশরুম চাষে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমি জানতে পারি যে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়। তারপর ওই প্রকল্প থেকে আমি প্রশিক্ষণ নিই। টিউশনি করে জমানো টাকা আর বাবার কাছ থেকে ধার নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ২০ শতাংশ জমিতে একটি টিনশেড ঘরে মাশরুম চাষ শুরু করি। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণের পর আমি নিজেই মাশরুমের বীজ উৎপাদন শুরু করি। এখন এখান থেকে অনেকেই বীজ কিনে নিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, মাশরুম শীতকালে বেশি উৎপাদন করা যায়। এখন আমার এখানে ১৫ হাজার মাশরুমের বীজ প্যাকেট রয়েছে এবং আট হাজার মাশরুমের স্পোন রয়েছে। এসব স্পোন থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কেজি মাশরুম উৎপাদন হয়। মাসিক হিসাবে এখান থেকে শীতের ছয় মাস প্রতিদিন ১০০ কেজির মতো মাশরুম পাওয়া যাবে, আর গরমকালের ছয় মাস ১০-১৫ কেজি পাওয়া যায়। গড়ে পাইকারি ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি খামার থেকে।  প্রতিদিন যে মাশরুম হয়, সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করি। আবার অনলাইনে (ফেসবুকের মাধ্যমে) যোগাযোগ করে জেলার বাইরে বিক্রি করি।

প্রথম বছরই মাত্র ২০ শতাংশ জমিতে টিন ও বাঁশের তৈরি মাশরুমের একটি চাষঘর থেকে খরচ খরচা বাদ দিয়ে নয় লাখ টাকার মতো লাভ হয়েছিল। পরের বছর ২০২২ সালে ২০ লাখ টাকার মতো লাভ হয়েছিল। এবার লাভ আরও বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।

তিনি বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে আমরা যদি একটু দেখে শুনে কোনো কিছুর উদ্যোগ নিই, তাহলেই নিজের পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। মাশরুম চাষ লাভজনক। এর মাধ্যমে নিজের পাশাপাশি অনেক বেকারদের বেকারত্ব দূর করা যায়।

সাগরের মাশরুম খামারে প্রায়ই সহযোগিতা করেন সাগরের ছোট ভাই জীবন।  

জীবন বাংলানিউজকে বলেন, এখন থেকেই ভাইয়ের কাছ থেকে মাশরুম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। নিজে এখন বীজ তৈরি করতে পারি। ভবিষ্যতে খামারটা আরও বড়  করব আমরা।

মাশরুম চাষি সাগরের সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই এখন মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়েছেন। বেশ কয়েকজন যুবক করেছেন নতুন খামার। আর নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি এসব মাশরুম চাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করছে এবং প্রদর্শনীর মাধ্যমে সহযোগিতা করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প।

একই উপজেলার দুর্গাপুর এলাকার রায়হান আলী। তিনি এবার উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে সাগরের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে খামার করেছেন।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি নতুন হিসেবে ২০০ প্যাকেট স্পোন নিয়ে মাশরুমের চাষ শুরু করেছি। কৃষি অফিস ও সাগর আমাকে পরামর্শ দেন। আগামীতে আমিও বীজ উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি।

সাগরের মাশরুম খামারে দুই বছর ধরে মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন জাহিদুল ইসলাম জনি। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, করোনার মধ্যে যখন কাজ-কাম ছিল না, তখন সংসারে প্রচুর অভাব দেখা দেয়। তখন এ মাশরুমের খামারে কাজ শুরু করি। তখন থেকেই মাসিক বেতনে এখানে কাজ করি। এখান থেকেই আমার সংসার চলে।

পড়ালেখার পাশাপাশি মাসিক বেতনে সাগরের মাশরুম খামারে অবসর সময়ে মাসিক আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করে স্কুলছাত্র সোহান। এখান থেকেই তার পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি হাতখরচও চলে।

যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সহযোগী পরিতোষ কুমার মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, নিয়মিত আমি সাগরের মাশরুম খামার পরিদর্শন করি এবং পরামর্শ দিই।  

কুমারখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস বাংলানিউজকে জানান, আমরা কৃষি অফিস থেকে মাশরুম চাষি সাগরকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। তিনি ছাত্রজীবনে মাশরুম চাষ করে বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। তার দেখাদেখি উপজেলার অনেক তরুণ ও কৃষক মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আমরা মাশরুম চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী দিয়ে সহযোগিতা করছি।

কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, লক্ষ্য অটুট থাকলে কোনো বাধাই শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সেটা প্রমাণ করেছেন আমাদের কুমারখালীর এক আত্মপ্রত্যয়ী যুবক  সাগর হোসেন। উদ্যোক্তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসন উদ্যোক্তা অ্যাপস ও ম্যাপসের ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া প্রয়োজনে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণও দেওয়া হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ বাংলানিউজকে জানান, মাশরুম চাষ খুবই লাভজনক। মাশরুম চাষের জন্য মাটির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া বাড়িতেই চাষ করা সম্ভব। কুমারখালীর সাগর নামে ওই তরুণ ছাত্রজীবনেই মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমরা জেলা জুড়েই মাশরুম চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছি।

যশোর অঞ্চলে টেকসই প্রকল্পের জুনিয়র পরামর্শক (মূল্য সংযোজন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন) মো. ইমরুল পারভেজ বাংলানিউজকে জানান, আমরা এ প্রকল্পের আওতায় পণ্যের মূল্য সংযোজন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। সেই সঙ্গে উচ্চ মূল্যের সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করছি। মাশরুম চাষ সম্প্রসারণ, বাজারজাতকরণ এবং এর মূল্য সংযোজনে কাজ করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প।  
 
যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, যশোর অঞ্চলে ছয়টি জেলার ৩১টি উপজেলায় আমরা মাশরুমসহ উচ্চ মূল্যের ফল, সবজি, ওষুধি ও মসলা জাতীয় ফসল এবং মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করছি। বিশেষ করে তরুণ ও কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করছি। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার আমাদের প্রকল্প থেকে প্রদর্শনী এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাগর হোসেন নামের বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। আমরা তার মাশরুম খামার পরিদর্শন করেছি। তার দেখাদেখি অনেক যুবক মাশরুম চাষে উৎসাহী হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।