ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বাংলার প্রাণের কাছে

দিনের দুঃখ ঢাকে সন্ধ্যার নৃত্য

মাহবুব আলম, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৬
দিনের দুঃখ ঢাকে সন্ধ্যার নৃত্য ছবি: নূর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঠাকুরগাঁও ঘুরে: অভাব এ অঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী। টানাপোড়েনের সংসার নির্বাহে তাই প্রায় সব পরিবারেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, এমনকি নারীদেরও দিনভর হাড়ভাঙা খাটতে হয়।

তবু শ্রমের ন্যায্যমূল্য জোটে না অধিকাংশের।  

জীবন-জীবিকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করলেও তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি। খাটুনি শেষে সন্ধ্যার পর যে অবসরটুকু মেলে, সে সময়েই নিজেদের শেকড়ের সন্ধান করেন সংস্কৃতিমনা সমতলের অন্যতম নৃ-গোষ্ঠীর অধিবাসী সাঁওতালরা।  

প্রতি সন্ধ্যায় নিজস্ব সংস্কৃতির আসর বসে অধিকাংশ সাঁওতাল পল্লীতে। এ সময় নাচ-গানের আড়ালে হারিয়ে যায় তাদের দিনের না পাওয়া আর বঞ্চনার দুঃখ।  

সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ঘুরে এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা যায়। কয়েকজন তরুণী তাদের লৌকিক নৃত্যও পরিবেশন করে দেখান। ‍

সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নিয়ে কথা হয় ঠাকুরগাঁও সদরের নারগুন এলাকার আদিবাসী নেতা সুমন বেসরার সঙ্গে। জানালেন, তাদের প্রধান কাজ কৃষি। তবে নিজেদের কোনো জমি-জমা নেই। অন্যের জমিতে কিংবা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারা। শত কষ্টের পরও দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী।  

তার সঙ্গে যোগ দিলেন প্রবীণ নারী সীতা হেম্রম। তার মতে, অন্যদের চেয়ে অনেক কম দামে আমরা মাটি কাটি, মাছ ধরি, কৃষি কাজ করি। শত বঞ্চনা আর কষ্ট থাকলেও সবাই মিলে হাসি-খুশি থাকার চেষ্টা করি।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রিক ভাষার পরিবারভুক্ত। কোল ও মুন্ডারি ভাষার সঙ্গেও এর মিল রয়েছে। সংস্কৃতিচর্চায় তাদের লিখিত সাহিত্যের বিকাশ না ঘটলেও লোকগীতি বা লোকজ সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ।  

নারগুনের বীরেন্দ্র মুন্ডার দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে সুজাতা মুন্ডা বলেন, আমাদের নিজস্ব ভাষায় কোনো লিখিত সাহিত্য নেই। লেখ্য বর্ণমালাও দেখিনি।  

‘মা-বাবা কিংবা এলাকার প্রবীণদের কাছ থেকে আমাদের নাচ, গীত কিংবা লোকজ বিষয়গুলো শিখি। আর বিয়ে, জন্মদিন বা ইস্টার সানডে’র সময় তা পরিবেশন করি। ’

স্থানীয় পঞ্চাশোর্ধ্ব বাসন্তী মার্ড্ডি বললেন, মাঘের এক তারিখে সাঁওতালরা শস্য বর্ষের দিন ‘বাহা’ উৎসব পালন করে। এ গান গাওয়া হয় করম উৎসবেও। এছাড়া ইস্টার সান ডে, বিয়েতে ঝুমুর গান, নাচ কিংবা ছৌ নাচ করা হয়। সাধারণ ভাষায় এগুলোকে সাঁওতাল নৃত্যই বলি আমরা।  

এসব গানের ভাষা ও কথায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং সুখ-দুঃখের প্রভাব থাকে বলে জানালেন তিনি।  

জানা যায়, লোকজ সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে সমৃদ্ধ সাঁওতালদের গানই ঝুমুর গান। এ গানের সঙ্গে নাচ করেন তরুণী কিংবা রমণীরা।  

এ লোকজ সংগীতের বিষয়ে সাঁওতাল পল্লীর প্রবীণ গনেশ সরেন বাংলানিউজকে জানান, করম উৎসবে ঝুমুর নাচ ও গান একত্রে পরিবেশন করা হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা সংক্রান্ত বিষয়টি প্রধান্য পায়।  

লোক গবেষক ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন, ‘ঝুমুরের গায়নরীতি মূলত অবরোহনধর্মী। চড়ার দিকে অনেকখানি গিয়ে ক্রমশ নেমে আসা হয় বক্রগতিতে। পরিশেষে খাদে এসে একটি পদে স্থিতিলাভ হয়।  

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম ঝুমুর গানের সুর ও আঙ্গিকে একাধিক গান রচনা করেছেন।  

‘সাধারণত করম উৎসবে সাঁওতালি ঝুমুর নাচ-গান এবং ছৌ ঝুমুর নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়। ’

ইতিহাস বলছে, ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ও নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাঁওতালরা। তাদের বিশ্বাস, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম জঙ্গল কেটে জমি চাষের উপযোগী করে, এর মালিকানা তারই। তাদের এ বিশ্বাস বা ঐতিহ্যকে বরাবরই সম্মান করায় মুঘলদের আমলে কোনো সমস্যা হয়নি।

লেখক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন, পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদাররা জমির উপর মালিকানা দাবি করেন। এ নিয়ে ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ সালে সাঁওতালদের মধ্যে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ, সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহটি ১৮৫৫-৫৬ সালে।  
 
এছাড়া ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল অবধি বাংলাদেশে তেভাগা আন্দোলনেও সাঁওতালদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কথা জানা যায়।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৬
এমএ/এসআর/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলার প্রাণের কাছে এর সর্বশেষ